কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিভাবে কাজ করে এবং এর ব্যবহারসমূহ
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: কম্পিউটারের নিজস্ব কোনো বুদ্ধি নেই। এটি শুধু নিজের কাছে সংরক্ষিত তথ্য এবং প্রোগ্রামের আলোকে কাজ করতে পারে। কোন সমস্যার আলোকে নিজ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করতে পারে না। কম্পিউটারও যাতে কোন সমস্যা দেখা দিলে নিজ থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারে তার জন্য এর ভেতর অনেক সমস্যার সমাধান ঢুকিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এটিকেই বলে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হলো মানুষের চিন্তাভাবনাগুলোকে কৃত্রিম উপায়ে কম্পিউটার বা কম্পিউটার প্রযুক্তিনির্ভর যন্ত্রের মধ্যে রূপ দেয়ার ব্যবস্থা। এটি বর্তমানে কম্পিউটার বিজ্ঞানের একটি শাখা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এই শাখায় কম্পিউটারকে মানুষের মতো চিন্তাভাবনা করে অসম্পন্ন তথ্য ব্যবহার করে পূর্ণাঙ্গ সিদ্ধান্তে পৌঁছবে, সমস্যার সমাধান করবে, পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে সেই বিষয়গুলো নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা চলছে।
১৯৫৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের MIT এর John McCarthy সর্বপ্রথম আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স শব্দটির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ক্রমেই এটি বিস্তার লাভ করছে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর ব্যবহার বেড়েই চলেছে।
বুদ্ধিমান আচরণের স্বাভাবিক গুণ
কম্পিউটারভিত্তিক সিস্টেমগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিচের যোগ্যতাগুলোকে প্রতিলিপিকরণের চেষ্টা করে-
- চিন্তা ও কারণ
- সমস্যা সমাধানে কারণগুলোকে ব্যবহার
- অভিজ্ঞতা থেকে শেখা বা বুঝা
- জ্ঞান অর্জন ও প্রয়োগ করা
- সৃষ্টিশীলতা ও কল্পনাশক্তির প্রদর্শন
- জটিল ও ধাঁধাময় পরিস্থিতিগুলোর সাথে কাজ করা
- নতুন পরিস্থিতিগুলোতে দ্রুত ও সাফল্যজনকভাবে সাড়া প্রদান কোনো পরিস্থিতিতে উপাদানগুলোর সম্পর্কের গুরুত্বকে সনাক্ত করা
- অস্পষ্ট, অসম্পূর্ণ কিংবা ত্রুটিপূর্ণ তথ্যকে মোকাবিলা করা।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জ্ঞানের ক্ষেত্রসমূহ
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারকে তিনটি প্রধান এলাকায় গ্রুপভুক্ত করা যায়। এগুলো হলো-
বুদ্ধিবৃত্তিক বিজ্ঞান
- এক্সপার্ট সিস্টেম (Expert Systems)
- লার্নিং সিস্টেম (Learning Systems)
- ফাজি লজিক (Fuzzy Logic)
- নিউরাল নেটওয়ার্ক (Neural Network)
- জেনেটিক অ্যালগরিদম (Genetic algorithm)
- ইন্টেলিজেন্ট এজেন্ট (Intelligent Agent)
রোবোটিক্স
- ভিজ্যুয়াল পারসেপশন (Visual Perception)
- ট্যাকটিলিটি (Tactility)
- ডেক্সটারিটি (Dexterity)
- লোকোমোশন ( Locomotion )
- নেভিগেশন (Navigation)
ন্যাচারাল ইন্টারফেস
- ন্যাচারাল ভাষা (Natural Languages)
- স্পিস রিকগ্নিশন (Speech Recognition)
- মাল্টিসেন্সরি ইন্টারফেস (Multisensory Interfaces)
- ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (Virtual Reality)
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে কাজ করে
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মূল বিষয়টি হলো ডেটা সায়েন্স। পৃথিবীতে বর্তমানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উৎকর্ষতার কারণে যে বিপুল পরিমাণ ডেটার সৃষ্টি হয়েছে, সেই ডেটাকে প্রক্রিয়া করার মতো শক্তিশালী কম্পিউটারও এখন তৈরি হয়ে গেছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সে এই ডেটাকে প্রক্রিয়াকরণের জন্য এমন একটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যা মানব মস্তিষ্ক যে উপায়ে কাজ করে তা নকল করার উদ্যোগ নেয়। সাধারণভাবে এটিকে নিউরাল নেটওয়ার্ক বা নিউরাল নেট নামে অভিহিত করা হয়।
নিউরাল নেটওয়ার্ক বা নিউরাল নেট হলো এমন একটি কম্পিউটিং ব্যবস্থা, যা অসংখ্য ডেটা বা তথ্যকে প্রক্রিয়া করে প্রত্যেকটি জিনিসকে মানুষের মতোই বুঝতে পারবে, তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে এবং ধীরে ধীরে বিভিন্ন ভুলত্রুটি শুধরিয়ে নেবে। যেমন: কম্পিউটার কোন গাড়ির ছবিকে কেবল কোনো ডেটা তথা 1 বা 0 হিসেবে না দেখে মানুষের মতো তার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে শনাক্ত করে গাড়ির ছবি হিসেবে চিহ্নিত করতে পারবে।
একটি আদর্শ নিউরাল নেটওয়ার্কে লক্ষ লক্ষ আর্টিফিশিয়াল নিউরন থাকতে পারে, এদেরকে ইউনিট (Unit) বলা হয়। এই ইউনিটগুলো একে অপরের সাথে ক্রমানুসারে সাজানো থাকে এবং প্রত্যেকে একে অপরের সাথে কানেক্টেড থাকে। এদের মধ্যে কিছু ইউনিট রয়েছে, যারা বিভিন্ন ধরনের তথ্য গ্রহণ করে, যেমন মানবমস্তিষ্ক কোন কিছুর আকার-আকৃতি, গঠন, রং ইত্যাদি দেখে একে চেনার বা শনাক্ত করার চেষ্টা করে। এই ইউনিটগুলোকে ইনপুট ইউনিট বলা হয়। এগুলো নিউরাল নেটওয়ার্ককে চিনতে, জানতে বা প্রসেস করতে সাহায্য করে।
নেটওয়ার্কের আরেক পাশে রয়েছে আউটপুট ইউনিট, যা কম্পিউটারটিকে ইনপুট থেকে যে জ্ঞান লাভ করে, সেটি প্রকাশ করতে দেবে। এই ইনপুট ইউনিট ও আউটপুট ইউনিটের মাঝামাঝি পর্যায়ে থাকে লুক্কায়িত স্তর বা Hidden unit, যা নেটওয়ার্কটির অধিকাংশ আর্টিফিশিয়াল নিউরন দ্বারা গঠিত। নিউরাল নেটকে যখন ইনপুট ও আউটপুট স্তর দিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, তখন লুক্কায়িত স্তরটি সে অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে থাকে।
মানব বুদ্ধিমত্তা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পার্থক্য
মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে, নিচে তা টেবিল আকারে উপস্থাপন করা হল-
মানব বুদ্ধিমত্তা | কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা |
---|---|
১. মানব বুদ্ধিমত্তা সরাসরি ইন্দ্রিয়সমূহের অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার | ১. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় করে তার পারদর্শীতা প্রদর্শন করে |
২. মানব বুদ্ধিমত্তা সৃষ্টিশীল | ২. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সৃষ্টিশীল নয় |
৩. মানব বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতাকে খুব সহজে প্রতিরূপ তৈরি বা অন্যকে সরবরাহ করা যায় না | ৩. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মূলত বিশেষ ধরনের সফটওয়্যার প্রোগ্রাম যা খুব সহজেই প্রতিরূপ তৈরি ও অন্যদের কাছে সরবরাহ করা যায় |
৪. মানব বুদ্ধিমত্তা প্রকৃতগতভাবে প্রাপ্ত | ৪. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের দ্বারা কৃত্রিম উপায়ে প্রাপ্ত |
৫. মানব বুদ্ধিমত্তা চিরস্থায়ী নয়; কোনো কারণে এই বুদ্ধিমত্তার অবনতি ঘটতে পারে | ৫. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সাধারণত চিরস্থায়ী। কম্পিউটার পদ্ধতি ও প্রোগ্রাম বদল করা না হলে এর স্থায়িত্বের হেরফের হয় না |
৬. মানব বুদ্ধিমত্তা ক্রমেই বিকশিত হতে পারে | ৬. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার স্বাভাবিকভাবে বিকাশের কোনো সুযোগ নেই |
৭. মানব বুদ্ধিমত্তাকে লিখে রাখা সম্ভব নয় | ৭. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে প্রোগ্রাম কোড আকারে লিখে রাখা যায় |
৮. এক জাতীয় কাজ হলেও মানব বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহারের বিষয়টি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যয়বহুল | ৮. একই জাতীয় কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার ততটা ব্যয়বহুল নয় |
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার সমূহ
১। মনুষ্যবিহীন গাড়ি এবং বিমান চালনার ক্ষেত্রে।
২। আবহাওয়ার সফল ভবিষ্যদবাণী করার ক্ষেত্রে।
৩। জটিল গাণিতিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে। যেমন-ম্যাকসিমা।
৪। ক্ষতিকর বিস্ফোরক শনাক্ত ও নিষ্ক্রিয় করার কাজে।
৫। চিকিৎসার ক্ষেত্রে। যেমন-মাইসিন।
৬। কাস্টমার সার্ভিস প্রদানে। যেমন-Automated online assistants.
৭। বিনোদন, সোশ্যাল মিডিয়া ও গেম খেলায়। যেমন- দাবা খেলায়।
৮। অনেক বড়, কঠিন ও জটিল কাজে।
৯। স্বয়ংক্রিয়ভাবে তথ্য সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে।
১০। পরিকল্পনা ও সিডিউল তৈরির ক্ষেত্রে।
১১। বিভিন্ন ডিভাইসের সূক্ষ্ম ত্রুটি শনাক্তকরণে।
১২। প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ খুঁজে বের করার কাজে।
১৩। ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা ও স্টক লেনদেন, ই-কমার্স এর ক্ষেত্রে।
১৪। বিভিন্ন অফিসে স্টাফদের প্রতিদিনের কর্মতালিকা বণ্টনে।
১৫। অনলাইনে সাহায্যকারী হিসেবে ওয়েবপেজে অ্যাভাটার হিসেবে।
১৬। যানবাহনে গতির সাথে মিল রেখে গাড়ির গিয়ার পরিবর্তন, অটো পাইলটের মাধ্যমে বিমান চালনা, যুদ্ধক্ষেত্র পরিচালনা, মহাকাশ গবেষণা প্রভৃতি কাজে।
১৭। আদালতে বিচারকার্য পরিচালনা, রায় প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রভৃতি কাজে।
১৮। কৃষি, ই-কমার্সসহ স্টক মার্কেটের শেয়ার লেনদেন প্রভৃতি কাজে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কুফল
১। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের ফলে মৌলিক গবেষণা ও সৃজনশীল কাজ থেকে মানুষ ধীরে ধীরে বিমুখ হয়ে পড়তে পারে।
২। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অপব্যবহার মানবজাতির জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।
৩। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারে বুদ্ধিসম্পন্ন বিষয়গুলোর নিয়ন্ত্রণও একসময় মানুষের হাতের বাইরে চলে
যেতে পারে।
এই হল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে সকল তথ্য, আরও কিছু জানার থাকলে অথবা এই লেখা নিয়ে কোন মন্তব্য বা অভিযোগ থাকলে কমেন্টে জানাতে পারেন।