জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং: প্রতিটি মানবদেহ অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোষের সমন্বয়ে গঠিত এবং প্রত্যেকটি কোষের মাঝে থাকে বংশগতির প্রধান উপাদান ক্রোমোজম (Chromosome)। এই ক্রোমোজমগুলো তৈরি হয় ডিএনএ (DNA-Deoxyribo Nuclic Acid) ডাবল হেলিক্স দিয়ে। ডিএনএ ডাবল হেলিক্স হলো ডিএনএ অণুর দ্বি-সূত্রী কাঠামো, যা সাধারণত সর্পিলাকারের হয়ে থাকে এবং এর একটি সূত্র অন্যটির পরিপূরক।
জীবকোষের ডিএনএ-এর ভেতরে থাকা যে ক্ষুদ্র অংশগুলো ঐ জীবের জীবনের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, তাকে জিন (Gene) বলে। অর্থাৎ, জীবদেহের ডিএনএ-এর বিভাজিত একক বৈশিষ্ট্যকে জিন বলা হয়। একটি ক্রোমোজোমে অসংখ্য জিন থাকতে পারে এবং প্রতিটি মানবদেহে এরকম ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার জিন রয়েছে।
কোনো জীবকোষে বিদ্যমান ক্রোমোজোমে উপস্থিত জিনের সমষ্টিকে জিনোম (Genome) বলা হয়। জিনোম হলো জীবের বৈশিষ্ট্যের নকশা বা বিন্যাস। এটিকে জীবদেহের নীলনকশা বলা হয়। অন্যকথায়, কোনো জীবদেহের কোষের সম্পূর্ণ ডিএনএ বিন্যাসের ক্রমকে ঐ জীবের জিনোম সিকোয়েন্স বলে।
একটি জীবের জিনোম সিকোয়েন্সের ওপর ঐ জীবের (প্রাণী বা উদ্ভিদের) বৈশিষ্ট্য কিরূপ হবে তা নির্ভর করে । জিনোম সিকোয়েন্স যত দীর্ঘ হবে, এর ধারণ করা তথ্যও তত বেশি হবে। কোনো জীব থেকে একটি নির্দিষ্ট জিন (Gene) বহনকারী DNA পৃথক করে ভিন্ন একটি জীবে স্থানান্তরের কৌশলকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বলে। অথবা, (জীন/ডিএনএ পরিবর্তন করার কৌশলকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বলে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং মূলত ট্রান্সজেনিক (উন্নত বৈশিষ্ট্যধারী) উদ্ভিদ ও প্রাণী সৃষ্টিতে কাজ করে।
সূচিপত্র-
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ইতিহাস
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে জীবদেহে জিনোমকে প্রয়োজন অনুযায়ী সাজানো বা একাধিক জীবের জিনোমকে জোড়া লাগিয়ে নতুন জীবকোষ সৃষ্টি করা যায়। যেহেতু জিন হচ্ছে প্রতিটি জীবের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের বাহক, তাই জিনোমের কোনো জিনকে পরিবর্তন করে ঐ জীবের কোনো বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করা যায়।
জিন ডিএনএ-এর একটি অংশ হবার কারণে ল্যাবরেটরিতে ডিএনএ-এর সেই অংশটুকু কেটে আলাদা করে অন্য কোনো প্রাণী বা ব্যাকটেরিয়া থেকে আরেকটি জিন কেটে এনে সেখানে লাগিয়ে দিতে হয়। ১৯৭০ সালে আণবিক কাঁচি নামে সমাদৃত রেস্ট্রিকশন এনজাইম (যা দিয়ে ডিএনএ অণু কাটা যায়) আবিষ্কারের পর মূলত জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর যাত্রা শুরু হয়।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এ গবেষণার মাধ্যমে যখন একটি জিন পরিবর্তন করে সেখানে অন্য জিন লাগানো হয়, তখন তাদেরকে একত্রে রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ বা RDNA প্রযুক্তি বলে। এ প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে DNA সূত্রের কাঙ্ক্ষিত খণ্ড বা অংশ ক্ষুদ্র এককোষী আবাদি জীব তথা ব্যাকটেরিয়া থেকে মানবদেহে, উদ্ভিদকোষ থেকে প্রাণীদেহে এবং প্রাণীকোষ থেকে উদ্ভিদদেহে স্থানান্তর করা সম্ভব হয়েছে।
আর এ কাজ সফল করতে কোনো এক জীবের DNA (জেনেটিক পদার্থ)-কে এমনভাবে পরিবর্তন করা হয়, যাতে তার নিজস্ব জিনের কাজ করার ক্ষমতা লোপ পায় কিংবা ভিন্ন কোনো জীবের জেনেটিক পদার্থের সাথে মিশে নতুন জিন বা বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করে। এসব RDNA সমৃদ্ধ জীবকোষকে বলা হয় Genetically Modified Organism (GMO)।
উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই অসংখ্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও ঔষধ কোম্পানি রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তি সফলভাবে প্রয়োগ করে বাণিজ্যিক সুবিধাদি গ্রহণ করছে। উদাহরণস্বরূপ- মানবদেহের ইনসুলিন তৈরির জিনকে ব্যাকটেরিয়া কোষে প্রবিষ্ট করে বাণিজ্যিকভাবে ইনসুলিন তৈরি করা হচ্ছে। তাছাড়া রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কৃষিজাত ফসল এবং উদ্ভিদের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে। এসব জাতকে ট্রান্সজেনিক (Transgenic) উদ্ভিদ বলে।
১৯৭২ সালে Paul Borg বানরের ভাইরাস SV40 ও lambda virus-এর ডিএনএ-এর সংযোগ ঘটিয়ে বিশ্বের প্রথম রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ অণু তৈরি করেন। ১৯৭৩ সালে E. coli ব্যাকটেরিয়ার প্লাসমিডের মধ্যে এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্ট জিন প্রবেশ করানোর মাধ্যমে Herbert Boyer এবং Stanley Cohen সর্বপ্রথম ট্রান্সজেনিক জীব তৈরি করেন।
রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ প্রযুক্তির ধাপ সমূহ
DNA নির্বাচন: উদ্ভিদের কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য বহনকারী DNA-কে নির্বাচন করা হয়।
DNA-এর বাহক নির্বাচন: নির্বাচিত DNA-কে বহন করার জন্য বাহক হিসেবে E. coli-কে নির্বাচন করা হয়। এ বাহকের প্লাজমিডকে DNA-র সাথে যুক্ত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। ব্যাকটেরিয়ার দেহে সাধারণ DNA অণু ছাড়াও অতিরিক্ত স্বনিয়ন্ত্রিত বৃত্তাকার যে DNA থাকে, তাকে প্লাজমিড বলে ।
DNA খণ্ড কর্তন: নির্দিষ্ট রেস্ট্রিকশন এনজাইম ব্যবহার করে নির্বাচিত DNA হতে সুবিধামতো DNA অংশটি কেটে নিতে হয়।
কর্তনকৃত DNA খণ্ড প্রতিস্থাপন: কর্তনকৃত DNA খণ্ডে লাইগেজ এনজাইম প্রয়োগ করে প্লাজমিড DNA-এর যথাস্থানে প্রতিস্থাপন করা হয়। পরিবর্তনকৃত প্লাজমিড DNA-কে রিকম্বিনেন্ট বলে।
পোষকদেহে রিকম্বিনেন্ট DNA স্থানান্তর: রিকম্বিনেন্ট DNA অণুকে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে পোষক ব্যাকটেরিয়ার দেহে প্রবেশ করানো হয়। এ DNA গ্রহণকারী ব্যাকটেরিয়াকে ট্রান্সফর্মড ব্যাকটেরিয়া বলে।
রিকম্বিনেন্ট DNA-র সংখ্যা বৃদ্ধি ও মূল্যায়ন: রিকম্বিনেন্ট DNA ব্যাকটেরিয়াকে কালচার মিডিয়ামে রেখে সংখ্যা বৃদ্ধি করানো হয়। এ সময় কাঙ্ক্ষিত জিনবাহী প্লাজমিডও পোষক কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি করে। এভাবে পোষকদেহে অধিক রিকম্বিনেন্ট DNA সৃষ্টি হয়।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কৃষি ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে বেগবান করে থাকে। যেমন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে আণুবীক্ষণিক জীব তথা- ব্যাকটেরিয়া, ইস্ট অথবা ইনসেক্ট ম্যামালিয়ান সেল ইত্যাদি থেকে বাণিজ্যিকভাবে প্রোটিন উৎপাদন করা যায়। বাণিজ্যিকভাবে পাউরুটি উৎপাদনে ইস্ট ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এছাড়াও কৃষি, খাদ্য ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
কৃষিতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রায়োগিক গুরুত্ব
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মূল গবেষণা কৃষিকে ঘিরে। এর সাহায্যে Genetically modified crops উৎপন্ন করা হয়, যা উচ্চফলনশীল, উন্নত জাতের, প্রকৃতি সহনশীল এবং রোগজীবাণু থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। এই বিষয়টি হাইব্রিড নামে বহুল পরিচিত। কৃষিতে Genetically modified crops উৎপাদনে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তিটি কৃষি সম্পদ উন্নয়নে যে ভূমিকা রাখতে পারে, সেগুলো হলো-
১. পরিবেশের বিভিন্ন হুমকি বা প্রতিকূলতা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে যেমন, অতিরিক্ত শীত সহ্য করা, পোকামাকড় দ্বারা আক্রান্ত না হওয়া, ভাইরাস ও ফাংগাস দ্বারা আক্রান্ত না হওয়া ইত্যাদি সক্ষমতাসম্পন্ন উন্নত বীজ উৎপাদনসহ মাটির লবণাক্ততা সহ্য করার মধ্য দিয়ে উন্নত ফসল নিশ্চিত করা।
২. ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়াকে ধ্বংস করার মাধ্যমে উন্নত কৃষিপণ্য উৎপাদনের পরিবেশ নিশ্চিত করা।
৩. শস্যের গুণগত মান বৃদ্ধি করা এবং অধিক ফলনশীল শস্য উৎপাদন করা। যেমন : Amflora potato.
৪. খরা, বৃষ্টি সহনশীল ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন স্বল্প সেচের প্রয়োজন হয় এমন শস্যের জাত উদ্ভাবন করা। উপর্যুক্ত সবগুলো কার্যক্রমই উন্নত কৃষি সম্পদকে নিশ্চিত করে বিধায় কৃষি সম্পদ উন্নয়নে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তির ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে।
প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর গুরুত্ব
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে মানুষের প্রয়োজন মেটাতে প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে এর প্রায়োগিক গুরুত্বসমূহ হলো- জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে উন্নত প্রজাতির গরু উৎপাদন কিংবা সাধারণ গরুকে ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে জেনেটিক্যালি মডিফাই করে অধিক মোটাতাজা করে তোলা যায়। এ ধরনের গরু অধিক মাংসের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি অধিক দুধ প্রদানেও সক্ষম হয়ে থাকে।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের জেনেটিক বিজ্ঞানীগণ মহিষের জিনতত্ত্ব বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর জীবনরহস্য উদঘাটনে সফল হয়েছেন। এর ফলে এখন উন্নত প্রজাতির মহিষ উৎপাদন সম্ভব, যা আমাদের কৃষিকাজে ব্যাপক সহায়ক হতে পারে । আমাদের দুগ্ধের চাহিদা মেটাতেও এ ধরনের মহিষ কার্যকর হতে পারে।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এ তথ্য প্রযুক্তির প্রয়োগ
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এ গবেষণার তথ্য ও ফলাফল গবেষকদের মধ্যে আদান-প্রদান ও মতবিনিময়ের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন প্রাণীর জিনের তথ্য এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল সংরক্ষণ করার জন্য ডেটাবেজ ব্যবহৃত হয়। এ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধাপে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত বিশেষ জটিল সিস্টেম ব্যবহৃত হয়। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রক্রিয়ায় গবেষণার জন্য কম্পিউটার সিম্যুলেশন ব্যবহৃত হতে পারে।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ব্যবহার
বর্তমান বিশ্বে বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য উৎপাদন, শিল্প উৎপাদন, পরিবেশ রক্ষাসহ মানবজীবনের নানা চাহিদা মেটাতে কাজ করছে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি। মেডিকেল সায়েন্স, ফার্মাসিউটিক্যালস ও কসমেটিক ইন্ডাস্ট্রির জীবন রক্ষাকারী ওষুধ উৎপাদন, এনজাইম ও হরমোন উৎপাদনে এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কৃষিতে উন্নত ফলনের জন্য জেনেটিক প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নিচে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ব্যবহার সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-
ইনসুলিন তৈরি
কৌশলগতভাবে পরিবর্তিত E-coli ব্যাকটেরিয়া ও ইস্ট হতে বাণিজ্যিকভাবে মানবদেহের ইনসুলিন উৎপাদন হলো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সবচেয়ে বড় সুফল। ইনসুলিন ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসায় প্রয়োজন হয় ।
উন্নতমানের ফসল উৎপাদন
ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের দেশে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তির ওপর বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, আখ গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রভৃতি সংস্থা কাজ করে অনেক উচ্চফলনশীল জাতের শস্যবীজ উৎপাদন করেছে।
এগুলোর মধ্যে উচ্চ ফলনশীল ব্রি (BRRI) জাতের বহু ভ্যারাইটির ধানের বীজ উদ্ভাবন, পার্পল বা বেগুনি কালারের উফশী ধান উদ্ভাবন উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও সয়াবিন, ভুট্টা, তুলা, তৈলবীজ, টমেটো, পেঁপে ইত্যাদির জিন বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে এগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধি, পোকা-মাকড় ও অন্যান্য উদ্ভিদনাশক ছত্রাক ও ভাইরাস প্রতিরোধ করা যাচ্ছে। জেনেটিক্যালি রূপান্তরিত ফসল অধিক খরা ও ঠান্ডা সহ্য করতে পারে।
রোগের চিকিৎসা
জিন থেরাপি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অন্যতম সুফল। জিন থেরাপির মাধ্যমে রোগের চিকিৎসা করে এবং ত্রুটিপূর্ণ জিন পরিবর্তন করে রোগীকে সুস্থ করে তোলা যায়।
ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য উৎপাদন
নির্দিষ্ট জিনের ক্লোনিং দ্বারা নতুন অনেক অত্যাধুনিক ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য উৎপাদন করা হয়। শিল্পজাত ব্যাকটেরিয়া থেকে উৎপাদিত হিউম্যান গ্রোথ হরমোন বামনত্ব (বেঁটে) রোধ করে এবং পোড়া ত্বক, ফেটে যাওয়া হাড় ও খাদ্যনালির আলসারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
ভাইরাসনাশক
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে তৈরি Interferon (মানব কোষ থেকে নিঃসৃত এক ধরনের রস) ভাইরাসনাশক (Anti viral) হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
টিকা ও জ্বালানি তৈরি
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ফলে জৈব কারখানায় প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন ও এনজাইম উৎপাদন করা যায়। এগুলো দিয়ে প্রচুর সংখ্যায় ট্রিপ্টোফ্যান (Tryptophan)-এর মতো টিকা ও সম্পূরক তৈরি করা সম্ভব। এছাড়া জ্বালানি তৈরিতেও এগুলো ব্যবহৃত হয়।
মৎস্য উন্নয়ন
স্যামন মাছের জিন স্থানান্তরের মাধ্যমে মাগুর, কার্প, তেলাপিয়া মাছের আকৃতি অনেক বড় করা সম্ভব হয়েছে।
পরিবেশ সুরক্ষা
বিজ্ঞানীরা জিন প্রকৌশলের ওপর গবেষণা করে নতুন ব্যাকটেরিয়া তৈরি করেছেন, যা পরিবেশ সুরক্ষায় অবদান রাখছে।
জেনেটিক ত্রুটিসমূহ নির্ণয়
গর্ভবতী মহিলাদের ভ্রূণ (Fetuses) দেখে সন্তানের জেনেটিক ত্রুটিসমূহ নির্ণয় করা যায়। পিতা-মাতা ও ডাক্তার মিলে শিশুর জন্মের পূর্বেই সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ঝুঁকিসমূহ
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে নতুন প্রজাতি উন্নয়নের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত ঝুঁকিসমূহ সর্বদা আমলে নিতে হবে। যথা-
প্রাণী ও মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে উৎপাদিত GMO পণ্যসমূহ বিষক্রিয়া মুক্ত হতে হবে। এতে কোনো প্রকার এলার্জি সৃষ্টিকারী উপাদান থাকলে, তা চিহ্নিত করতে হবে। এর কোয়ালিটি মানুষের খাদ্য উপযোগী না, পশুখাদ্য উপযোগী তা নির্দিষ্ট করতে হবে।
পরিবেশ ঝুঁকি
যদিও পরিবেশের ওপর GMO এর প্রভাব নির্ধারণ কঠিন, তদুপরি এক্ষেত্রে কতিপয় বিষয়ের ঝুঁকি যথাসম্ভব নির্ধারণ করা আবশ্যক। যেমন GMO এর মাঝে প্রবেশকৃত জিন বা ঐ জিনের প্রোডাক্ট (প্রোটিন) পরিবেশে উন্মুক্ত অবস্থায় কতদিন অবস্থান করতে পারে, GMO ব্যতীত অন্যান্য জীব ঐ ট্রান্সজেনিকের প্রতি কতটা সংবেদনশীল, অপ্রত্যাশিত জিনের প্রকাশ বা ট্রান্সজিনের স্থায়িত্বের অভাব ঘটছে কি না এ বিষয়গুলো নির্ধারণ করা জরুরি। এছাড়াও ট্রান্সজিনের প্রকাশের ফলে বাস্তুসংস্থানের প্রভাব, মাটির উর্বরতার ওপর প্রভাব, জৈবযৌগ ও জৈববৈচিত্র্যের পরিবর্তনের প্রভাব প্রভৃতি ঝুঁকিগুলোও এক্ষেত্রে বিবেচনায় নিতে হবে।
চাষ ঝুঁকি
এই বিভাগে যে সমস্ত বিষয় খেয়াল রাখতে হয়, তা হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশে কাঙ্ক্ষিত জীবের টিকে থাকার সামর্থ্য, পরিবর্তনশীল চাষ খরচ (আগাছা বা পোকা-মাকড় দমনের ক্ষেত্রে), পুষ্টিমানের পরিবর্তন, আগাছার প্রতি সংবেদনশীলতা ইত্যাদি। এই বিভাগের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আগাছা বা উৎকৃষ্ট আগাছা সৃষ্টি করার ক্ষমতা পর্যবেক্ষণ করা। কারণ কোনো GM শস্য যদি কোনো Super Weed সৃষ্টি করে, তবে অন্য ফসলের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে।
এছাড়াও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর আরও কিছু কুফলের মধ্যে রয়েছে-
- জীববৈচিত্র্য হ্রাসের কারণে জীবজগতে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি
- অনৈতিক বা অযাচিতভাবে জিনের স্থানান্তর
- মানবদেহে প্রয়োগযোগ্য এন্টিবায়োটিক ঔষধের কার্যকারিতা হ্রাস ও অ্যালার্জির উদ্ভব
- ভয়াবহ বা জীববিধ্বংসী প্রজাতি বা ভাইরাস উদ্ভবের আশঙ্কা
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। দেশে ধান, পাট, আখ প্রভৃতি গবেষণা কেন্দ্র প্রতিনিয়ত উন্নতমানের সার বীজ আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ব্যাপক সফলতাও অর্জন করেছে। বাংলাদেশে মিষ্টি আপেল কুল, পেয়ারা, পেঁপে প্রভৃতি ফলের উন্নত বীজ আবিষ্কারের ফলে এই ফলগুলোও ব্যাপক অর্থকরী ফসলের ভূমিকা রেখে চলেছে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বাংলাদেশের বিশেষ সাফল্য হলো, পাটের জীবন রহস্য বা জিনোম সিকোয়েন্সের আবিষ্কার।
বাংলাদেশের প্রখ্যাত জীনতত্ত্ববিদ ডঃ মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট গবেষণা কেন্দ্র এবং তথ্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডেটা সফট-এর একদল তরুণ উদ্যমী বিজ্ঞানী ও গবেষকগণের যৌথ প্রচেষ্টায় ২০১০ এর মাঝামাঝিতে পাটের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কৃত হয়। ডঃ মাকসুদুল আলম এর আগে পেঁপেরও জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন করেন।
কিছু ঝুঁকি থাকার পরও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বর্তমান সভ্যতার জন্য অনেক বড় আশির্বাদ, ভবিষ্যতে বিপুল জনসংখ্যার জন্য তৈরি হওয়া সমস্যাগুলো শুধুমাত্র জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তিই সমাধান করতে পারবে।